বছরজুড়ে প্রস্তুতি নিয়েও আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) লক্ষ্য ছিল গত অক্টোবরের মধ্যেই সব বই ছাপানো শেষ করা। কিন্তু বাস্তবে নবম শ্রেণির বইয়ের অগ্রগতি মাত্র ২০ লাখ কপিতে সীমাবদ্ধ, আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির সাড়ে ১৪ কোটি বই ছাপানোর কাজ এখনো শুরুই হয়নি। ফলে নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দুই মাসে দেশের এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী বইবিহীন অবস্থায় পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছে।
গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে পাঠ্যবই ছাপায় দেরি হলেও এবার এমন কোনো অজুহাত মানতে রাজি নয় কেউ। ছাপাখানার মালিকরা দেরির জন্য দায়ী করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তাদের গাফিলতিকে, অন্যদিকে বোর্ড কর্মকর্তারা দায় চাপাচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর। তাদের দাবি— মন্ত্রণালয় অকারণে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের ক্রয়াদেশে অনুমোদন না দিয়ে টেন্ডার বাতিল করেছিল, যার ফলে পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্যই পুনরায় টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল।” কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে, রিটেন্ডারেও সেই সিন্ডিকেট অটুট থেকেছে; বরং পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের প্রতি ফর্মার বাজেট ছিল ৩ টাকা ১৫ পয়সা, অথচ বাজারমূল্য অন্তত ২ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু কিছু ছাপাখানা সিন্ডিকেট গঠন করে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯ পয়সা পর্যন্ত দর দিয়ে কাজ নিয়েছে। এতে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে—আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রব্বানী জব্বার ও মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেডের মালিক মো. কবিরের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটটি গঠিত হয়েছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও তাদের নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল।
এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপাচ্ছে মোট ১০৩টি প্রেস, যার মধ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির সাড়ে ১৪ কোটি বইয়ের অর্ধেকের বেশি কাজ পেয়েছে রব্বানী-কবির সিন্ডিকেটের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো।
এনসিটিবি এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করে মে-জুলাইয়ের মধ্যে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেয়। লক্ষ্য ছিল অক্টোবরের মধ্যে ছাপা শেষ করে ডিসেম্বরে সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু সেপ্টেম্বরে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি অনুমোদন না দেওয়ায় টেন্ডার বাতিল হয়ে যায়। রিটেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও আড়াই মাস লেগে যায়। নবম শ্রেণির বইয়ের ক্রয়াদেশের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) জারি হয়েছে ২৭ অক্টোবর, আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বইয়ের নোয়া জারি হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। চুক্তি কার্যক্রমে আরও ২৮ দিন সময় লাগবে। ফলে ছাপানো শুরু হতে ডিসেম্বর, শেষ হতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগবে।
পাঠ্যবই সংকটের পেছনে এনসিটিবির অভ্যন্তরীণ অরাজকতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। অভিযোগ রয়েছে, বোর্ডে এখনো আগের সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের স্বার্থে সক্রিয়। ছাত্রদল এক বিবৃতিতে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ড. রিয়াদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রবিউল কবীর চৌধুরীর অপসারণ দাবি করেছে।
এদিকে প্রাথমিক স্তরেও মান-সংকট দেখা দিয়েছে। এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে বেসরকারি তৃতীয় পক্ষ ইনফিনিটি সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন (বিডি) দ্বারা বইয়ের মান যাচাই করা হলেও, তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রাথমিকের প্রায় ৩০ শতাংশ বই নিম্নমানের কাগজে ছাপানো হয়েছে। ইন্সপেকশন কোম্পানির মালিক মো. মনিরের বিরুদ্ধে ছাপাখানাগুলোর কাছ থেকে কাগজ অনুমোদনের বিনিময়ে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এক ছাপাখানা কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ২ লাখ টাকা দিয়েছি, আরও ৫ লাখ চাওয়া হয়েছে। না দিলে কাগজ অনুমোদন আটকে রাখা হচ্ছে।” তবে অভিযুক্ত মনির এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “কাগজের মানে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কেউ ম্যানেজ করতে চাইলে তাদের প্রস্তাব আমি গ্রহণ করিনি।”
সবমিলিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা, সিন্ডিকেট, এবং দুর্নীতির চাপে নতুন শিক্ষাবর্ষে সময়মতো পাঠ্যবই বিতরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাজীবনে সরাসরি আঘাত হানবে।

